সোনাদিয়া দ্বীপে রয়েছে সাত লাখ টন মূল্যবান খনিজ সম্পদ, বছরে ২ হাজার কোটি টাকার আয়ের সম্ভাবনা
কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার ছোট্ট দ্বীপ সোনাদিয়া। ম্যানগ্রোভ ও উপকূলীয় বনের সমন্বয়ে গঠিত দ্বীপটির আয়তন নয় বর্গকিলোমিটার। চারদিক জলরাশিতে ঘেরা এ ভূখণ্ডে পাওয়া গেছে ভারী প্রাকৃতিক খনিজ—ইলমেনাইট, ম্যাগনেটাইট, গারনেট, জিরকন, রুটাইল ও মোনাজাইট।
সোনাদিয়ায় এ ধরনের মূল্যবান খনিজ সম্পদের পরিমাণ আনুমানিক সাত লাখ টন। এর মধ্যে গারনেট ও ইলমেনাইটের আধিক্য সবচেয়ে বেশি। মূল্যবান এ সম্পদের আর্থিক হিসাব এখনো নির্ধারিত না হলেও, বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলন করা গেলে দেশের অর্থনীতিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ভূতত্ত্ববিদরা।
সম্প্রতি সোনাদিয়া দ্বীপের মূল্যবান সম্পদ নিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক গবেষণা জার্নাল ‘ডিসকভার জিওসায়েন্স’। নিউজিল্যান্ডের ডানেডিনের ওটাগো বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়ার ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চার গবেষক—মো. শাখাওয়াত হোসেন, মো. শাহরিয়ার রহমান, গোলাম তাকি ও মাফতুহা জাহান—গবেষণাটি পরিচালনা করেন।
‘জিওলজিক্যাল ক্যারেক্টারাইজেশন অ্যান্ড রিজার্ভ এস্টিমেশন অব দ্য ইকোনমিক হেভি মিনারেলস অব সোনাদিয়া আইল্যান্ড, বাংলাদেশ’ শীর্ষক এই গবেষণায় দ্বীপটির খনিজভিত্তিক সম্ভাবনা ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিশ্লেষণ করা হয়।
গবেষণায় দেখা যায়, দ্বীপটির বালির নমুনায় গারনেটের পরিমাণ ৫১.৫২ শতাংশ এবং ইলমেনাইট ৩৮.১৪ শতাংশ। এছাড়া ম্যাগনেটাইট ৫.৭৪, জিরকন ১.০১, রুটাইল ৩.৫৭ এবং মোনাজাইট ০.১ শতাংশ পাওয়া গেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার চরেও ইলমেনাইট, রুটাইল, গারনেট ও জিরকনসহ বিভিন্ন খনিজের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে।
গবেষকদের দাবি, সোনাদিয়া দ্বীপের বালিয়াড়িতে ভারী খনিজ পদার্থের ঘনত্ব সৈকতের অন্যান্য অংশ—তীরবর্তী এলাকা (ব্যাকশোর) ও সাগরতীর (ফোরশোর)—এর তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। তাদের হিসাবে, বালিয়াড়ির বালিতে গারনেট রয়েছে প্রায় ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৬৮ টন, ফোরশোরে ১৯ হাজার ৭৯৪ টন এবং ব্যাকশোরে ৪৭ হাজার ৩২৪ টন।
বালিয়াড়ির বালিতে ইলমেনাইটের পরিমাণ প্রায় ২ লাখ ১৫ হাজার ৯২ টন। ফোরশোরে ১৫ হাজার ১৬ টন এবং ব্যাকশোরে ৩০ হাজার ৪৮৭ টন। গবেষণায় বলা হয়, সমুদ্রের ঢেউ, স্রোত এবং পলি জমার প্রাকৃতিক প্রবাহের কারণে ভবিষ্যতে এ খনিজ সম্পদের পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।
তবে গবেষণায় উল্লেখিত সাত লাখ টন ভারী খনিজের পরিমাণকে “যৎসামান্য” বলে মন্তব্য করেছেন ইনস্টিটিউট অব মাইনিং, মিনারেলজি অ্যান্ড মেটালার্জি (IMMM)-এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ আমিনুর রহমান বণিক বার্তাকে জানান,
“সোনাদিয়া দ্বীপে সাত লাখ টনের যে হেভি মিনারেল পাওয়ার কথা বলা হচ্ছে, সেটা খুবই সামান্য। বাণিজ্যিকভাবে কাজে লাগানো সম্ভব কি না, তা আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বলা যাবে।”
তিনি আরও বলেন,“কক্সবাজার, টেকনাফ, মহেশখালী ও সোনাদিয়া দ্বীপের ভারী খনিজ নিয়ে ১৯৮০ সালেও গবেষণা হয়েছে। তখনকার তথ্যে ওই অঞ্চলে ২১ মিলিয়ন (২ কোটি ১০ লাখ) টন খনিজ থাকার কথা বলা হয়েছিল। তবে এসব খনিজ বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলন ব্যয়বহুল। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি কতটা লাভজনক হবে, তা বিবেচনা করতে হবে।”
ভৌগোলিক অবস্থান ও ব্লু ইকোনমি-এর দিক থেকে সোনাদিয়া দ্বীপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইতিমধ্যেই দ্বীপটির পর্যটন ও মৎস্যশিল্প স্থানীয় অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। গত বছর ইকো-ট্যুরিজম পার্ক গড়ে তোলার শর্তে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) অনুকূলে ৯,৪৬৭ একর জমি বরাদ্দ দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। যদিও এ বিষয়ে আদালতের স্থগিতাদেশ রয়েছে।
বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের সূত্রে জানা গেছে, সরকার বর্তমানে নদীর বালি প্রক্রিয়াকরণের দিকে এগোচ্ছে। এর জন্য লজিস্টিক সক্ষমতা বাড়াতে প্রকল্পও নেওয়া হয়েছে। তবে সমুদ্র বা দ্বীপাঞ্চলের বালি নিয়ে এখনো কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের মতে, প্রতি বছর নদীতে যে পরিমাণ পলি আসে তার মাত্র ১০ ভাগও যদি প্রক্রিয়াজাত করে খনিজের বাণিজ্যিক ব্যবহার করা যায়, তবে বছরে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব।
ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আবদুল মান্নান বলেন,“সোনাদিয়া দ্বীপের খনিজসম্পদ বিষয়ে আমার কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে সরকার নদীর বালি প্রক্রিয়াকরণের কাজ শুরু করেছে।”
গবেষণায় দেখা যায়, সোনাদিয়া দ্বীপের প্রতিটি খনিজের রাসায়নিক গঠন অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এতে জিরকন, রুটাইল ও ইলমেনাইটে মূল উপাদানগুলোর উচ্চ ঘনত্ব পাওয়া গেছে। এছাড়া অ্যাম্ফিবোল, মাসকোভাইট, কোয়ার্টজসহ অন্যান্য খনিজের উপস্থিতিও নির্ণয় করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে চিহ্নিত খনিজগুলোর মধ্যে ইলমেনাইট ও রুটাইল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো থেকে উৎপাদিত টাইটানিয়াম ডাই-অক্সাইড রঙ, প্লাস্টিক, কাগজের আবরণ ও বিশেষ ধাতু মিশ্রণে অপরিহার্য। জিরকন সিরামিক, কাচ ও ঢালাই শিল্পে তাপসহনীয়তা ও উজ্জ্বলতা বাড়ায়; কেটে ও পলিশ করলে রত্ন হিসেবেও ব্যবহার করা যায়।
গারনেট ব্যবহৃত হয় জেট-কাটিং ও পলিশে অসাধারণ অ্যাব্রেসিভ পদার্থ হিসেবে, আবার গহনা তৈরিতেও। মোনাজাইটে থাকে দুর্লভ উপাদান, যা নবায়নযোগ্য জ্বালানির টারবাইন থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিক্সেও গুরুত্বপূর্ণ। ম্যাগনেটাইট লোহা-ইস্পাত শিল্পের কাঁচামাল, আর কায়ানাইট ব্যবহৃত হয় রিফ্র্যাক্টরি ইট ও বিশেষ সিরামিক তৈরিতে।
অবকাঠামো, পেইন্ট, প্লাস্টিক ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি শিল্পে এসব খনিজের চাহিদা ক্রমবর্ধমান। তাই শুধু বালি বিক্রি না করে খনিজ পৃথকীকরণ, শোধন ও ব্র্যান্ডভিত্তিক রপ্তানির সুযোগ রয়েছে বহুগুণে।
দেশের দ্বীপাঞ্চল ও চরাঞ্চলের খনিজ উত্তোলনে সরকারের সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ বদরুদ্দোজা মিয়া বলেন,“আমাদের দেশের নদীবাহিত চরাঞ্চল ও সমুদ্রদ্বীপে ভারী খনিজ পদার্থ রয়েছে। সরকার ইতিমধ্যে এসব নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। যমুনার চরের খনিজ নিয়ে একটি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্সও দেওয়া হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন,“সোনাদিয়া দ্বীপে অবশ্যই হেভি মিনারেল আছে। তবে এগুলো নিয়ে সঠিক গবেষণা হওয়া জরুরি। শুরুতেই বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে স্টাডি না করাই ভালো, কারণ এসব খনিজের সঙ্গে অনেক রেয়ার আর্থ এলিমেন্টও রয়েছে—যেগুলো অত্যন্ত মূল্যবান। তাই ধীরে-সুস্থে সরকারি সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বাড়িয়ে গবেষণা করা উচিত।”

আপনার মতামত লিখুন